প্রধান উপদেষ্টার সহকারী পরিচয়ে ওসির কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি

নিজস্ব প্রতিনিধি: মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) চট্টগ্রাম পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করার অভিযোগ উঠেছে। গণহত্যার মামলা থেকে তার নাম বাদ দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে তার কাছে এ চাঁদা দাবি করা হয়।

চাঁদা দাবি করা ওই ব্যক্তি নিজেকে হাবিবুর রহমান বলে পরিচয় দেন। এছাড়া তিনি গ্রামীণ সেন্টার নামে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত সহকারী বলে দাবি করেছেন।

বুধবার (১৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় ওসির মুঠোফোনে কল করে চাঁদা দাবির ৭ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের অডিও রেকর্ড চাটঁগার টিভির বার্তা সম্পাদকের হাতে এসেছে। তবে ওসি কেপায়েত উল্লাহ বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

পুলিশ বলছে, এটি প্রতারক চক্রের কাজ। চাঁদা দাবিকারী ওই ব্যক্তিকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে। যাচাই-বাছাই শেষে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেপায়েত উল্লাহর সরকারি মুঠোফোনে ফোন করে গণহত্যার মামলা থেকে তার নাম বাদ দিতে এ চাঁদা দাবি করা হয়। চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা একটি তালিকা করেছে এবং তালিকায় তার থানার নাম আছে বলেও দাবি করেন ওই ব্যক্তি। তবে, ঠিক কখন কোন নম্বর থেকে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করা হয়েছে তা জানা যায়নি।

ওসি কেপায়েত উল্লাহ চাঁদা দাবির বিষয়টি চাটঁগার টিভির এর কাছে অস্বীকার করলেও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিএমপির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

সাত মিনিট ৫২ সেকেন্ডের ওই অডিও রেকর্ডের শুরুতেই ওসি কেপায়েত উল্ল্যাহকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার পাহাড়তলী থানাতে কোনো ঘটনাই নাই। গণহত্যাতে আমরা কিভাবে যাব?’

উত্তরে চাঁদা দাবিকারী ওই ব্যক্তি বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন, ঢাকা মেট্রোপলিটনের ম্যাক্সিমাম ওসি এখানে জড়িত আছে। এরপর এই লিস্ট দুদকে চলে যাবে…ঝামেলায় পড়ে যাবেন যদি হয় আর কি। যদি প্রথমেই বাদ যান তাইলে ঝামেলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে যাবেন। আমি জানি যে আপনার ওখানে তেমন কিছু হয়নায়…।’

ওসি বলেন, ‘আমার এখানে তো ঘটনায় নাই। তাইলে আমি কেন এখানে…।’ তার কথা শেষ না হতেই ওই ব্যক্তি বলেন, ‘না না, ঘটনা নাই কিন্তু ঘটনার লিস্ট তো চলে আসছে। এখন এটা অলরেডি চলে আসছে এবং রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়ে গেছে।’

ওসি তার নাম জানতে চাইলে তিনি নিজেকে হাবিবুল ইসলাম পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আমরা গ্রামীণ সেন্টারে ছিলাম এখন ওনার (ড. ইউনূস) ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করতেছি। আগেও করছি, এখনো আছি।’

অডিও রেকর্ডটির ১ মিনিট ১৮ সেকেন্ডে ওই ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘এখানে একটা অপশন আছে অব্যাহতি দেওয়ার। ধরেন আপনার থানায় কোনো হত্যাকাণ্ড বা কিছু হয়নায়। এখন এই অপশনে… এখন যেহেতু লিস্টভুক্ত হয়ে চলে আসছে। এখান থেকে সহজে বাদ দেওয়ার কোনো উপায় নেই। এখন আমরা হয়তো এখানে আমাদের টিম আছে, কাজ করে এগুলা। এটা প্রধান উপদেষ্টার কাছে চলে গেলে চলে যাবে কোর্টে।’

‘কোর্টে একটা উকিল এটাকে ইয়ে করে হয়তো এটা হত্যা মামলায় ইয়ে হয়ে যাবে। আর এখানে ছাত্রদের সহযোগিতায় সাক্ষী-টাক্ষীসহ অনেক কিছুর ব্যাপার আছে। যাহোক এটা পরে বলবো। এখন বের হওয়ার একটা অপশন আছে। আপনি কিভাবে বের হতে চাচ্ছেন এটা আপনার ব্যাপার। আপনি বলেন।’

কৌশলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা থেকে বের হওয়ার উপায় জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘অপশনটা… কোনো অপশন নাই এখানে আসলে। এখানে অপশন তো ধরেন…আচ্ছা কালকে আপনি আমাকে ১০টার দিকে একটা ফোন দিয়েন। আমি অফিসে কথা বলে জানবো।’

পরে অডিওর ২ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে তিনি বলেন, ‘এখানে খোলামেলা হচ্ছে আপনাকে ফিনানশিয়ালভাবে যদি কিছু ইয়া দেন তাইলে আমি বলে এটা বাদ দিতে পারবো যে, ওখানে কিছু হয়নায়। আমরা এখান থেকে এটা আউট করে দিলাম। সংখ্যাতো কমানো যাবে না। এখানে অন্য একটা নাম অ্যাড করে দিলাম। ঢাকা থেকে বা অন্য কোনো সেক্টর থেকে। এখানে আসলে… ফিনানশিয়ালটা আপনাকে দিতে হবে। ভালো একটা এমাউন্ট দিতে হবে। নাহলে তো এখান থেকে একটা লোককে আউট করে আরেকটা লোককে দেওয়া ব্যাপার আছে। আপনি মিনিমাম লাখ ফিফটির মতো খরচ করতে হবে।’

আমার থানায় কোনো গণহত্যা হলো না। আমি গণহত্যার আসামি হয়ে গেলাম—ওসি এমন প্রশ্ন রাখলে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাকে শুরুতেই বলছি ঢাকা মেট্রোপলিটন চট্টগ্রাম এখানে অনেক থানাই জড়িত হ্যাঁ? এখানে এই লিস্টটা আসছে মূলত চট্টগ্রাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটা লিস্ট। প্রধান উপদেষ্টা মূলত ছাত্রদের সাথে সমন্বয় করতেছে বেশি। এখন এটা সংখ্যা কমাইলে ওদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এটা সংখ্যায় কমানো যাবে না। লোক বের করে অন্য একটা লোক অ্যাড করতে পারবো। ’

অডিও রেকর্ডটির সাড়ে ৫ মিনিটের মাথায় চাঁদা দাবি করা ওই ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘এখন আপনি কতটুকু কি করতে পারবেন বলেন। এটা আমাদের টিমের ব্যাপার তো। এখানে সংখ্যা কমানো যাবে না।’

অডিও রেকর্ডের শেষাংশে ওসিকে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘যাহোক, আপনি কাল সকাল ৯টার দিকে কতটুকু কি করতে পারবেন আমাকে জানাইয়েন। তাইলে আমরা এটা ডিসিশন নিতে পারবো, নাহয় কিছু করার নাই।’

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, চট্টগ্রামের সমন্বয়ক মোহাম্মদ রাসেল আহমেদ চাটঁগার টিভির কে বলেন, ‘আমরা এরকম কোনো তালিকা করিনি। আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি। যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন করেছে তারা বাংলাদেশকে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস খুনমুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে কাজ করেছে এবং এখনো করছে। যিনি চাঁদা দাবি করেছেন তাকে আইনের আওতায় আনার অনুরোধ করছি প্রশাসনের কাছে।’

ওই নামে ড. ইউনূসের কোনো ব্যক্তিগত সহকারী নেই জানিয়ে গ্রামীণ সামগ্রীর সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুসা খান চাটঁগার টিভি’কে বলেন, ‘এই নামে কষ্মিনকালেও ড. ইউনূস স্যারের কোনো ব্যক্তিগত সহকারী ছিল না। ওসির সঙ্গে যিনি এই কাজ করেছেন তিনি ভুয়া প্রতারক। তাকে চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত।’

ঘটনাটি অস্বীকার করে পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কেপায়েত উল্লাহ সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘কই নাতো, এরকম কিছু আমার কাছে নাই।’

এদিকে, মুঠোফোনে কল করে চাঁদা দাবির বিষয়টি নিশ্চিত করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগর পুলিশের অন্য দুই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চাটঁগার টিভির কে বলেন, ‘পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেপায়েত উল্লাহর কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে একটি কল এসেছিল। কল রেকর্ডটি আমরা শুনেছি। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতনরা এটি নিয়ে কাজ করছেন।’

এ বিষয়ে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজ চাটঁগার টিভিরকে বলেন, ‘এটি প্রতারক চক্রের কাজ। বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আমরা এটিকে প্রতারণা বলেই ধরে নিচ্ছি।