অনলাইন ডেস্ক : আমার সোনার বাংলা হলো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। বঙ্গমাতা সম্পর্কে এই গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ১৯০৫ সালে রচিত হয়। বাউল গায়ক গগন হরকরার গান "আমি কোথায় পাব তারে" থেকে এই গানের সুর ও সঙ্গীত নকল করে আমার সোনার বাংলা রচিত হয়।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই গানটি রচিত হয়েছিলো। ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ চরণ সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বাউল” নামক গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত আছে।
আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয়েছিলো ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। গানটির পাণ্ডলিপি পাওয়া যায়নি, তাই এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না। সত্যেন রায়ের রচনা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম গীত হয়েছিলো। এই বছরই ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) সঞ্জীবনী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে গানটি মুদ্রিত হয়। এই বছর বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি মুদ্রিত হয়েছিলো। তবে ৭ আগস্ট উক্ত সভায় এই গানটি গীত হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিশিষ্ট রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, আমার সোনার বাংলা ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে অবস্থা ও ব্যবস্থা প্রবন্ধ পাঠের আসরে প্রথম গীত হয়েছিলো।
আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয়েছিলো বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের ডাকপিয়ন গগন হরকরা রচিত আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে গানটির সুরের অণুষঙ্গে। সরলা দেবী চৌধুরানী ইতিপূর্বে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে তার শতগান সংকলনে গগন হরকরা রচিত গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ-সমসাময়িক অনেক স্বদেশী গানের সুরই এই স্বরলিপি গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছিলো।যদিও পূর্ববঙ্গের বাউলদের ভিডমিড ও ভাটিয়ালি সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি ইতঃপূর্বেই হয়েছিলো বলে জানা যায়। ১৮৮৯-১৯০১ সময়কালে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারির কাজে ভ্রমণ ও বসবাসের সময় বাংলার লোকজ সুরের সঙ্গে তার আত্মীয়তা ঘটে। তারই অভিপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী আন্দোলনের সমসাময়িক গানগুলি, বিশেষত আমার সোনার বাংলা।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আয়োজিত এক জনসভায় গানটি গাওয়া হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পরে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের আগেও গানটি গাওয়া হয়েছিল। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্যারেডেও গানটি গাওয়া হয়। মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এই গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটির বর্তমানে প্রচলিত যন্ত্রসুর করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয়।[
১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ চরণ সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
২০১৯ সালে, ভারতীয়-বাংলা সঙ্গীতানুষ্ঠান সা রে গা মা পা বাংলায় রানার-আপ হওয়া বাংলাদেশী গায়ক মঈনুল আহসান নোবেল এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, “রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ যতটা না দেশকে প্রকাশ করে তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি প্রকাশ করেছে প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘বাংলাদেশ’ গানটি”। তার এই মন্তব্য বাংলাদেশিদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করে। পরে তিনি নিজের মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চান।
২০২৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গোলাম আজমের মেঝো ছেলে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় জাতীয় সংগীত নিয়ে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পুনরায় লেখা উচিত, কারণ বর্তমান জাতীয় সংগীতটি মূলত ভারত কর্তৃক প্রণীত”। তার মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত "আমার সোনার বাংলা" গানটি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রেক্ষাপটে দুই বাংলাকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল। আযমী বলেন, "বাংলাদেশ স্বাধীন একটি রাষ্ট্র, তাই আমাদের জাতীয় সংগীতও নতুনভাবে হওয়া উচিত।" তিনি আরও বলেন, "আমরা কি দুই বাংলা এক করার জন্য কাজ করছি, নাকি স্বাধীন বাংলাদেশকে রক্ষা করতে চাই? ১৯৭১ সালে ভারতের চাপের ফলে আমাদের অস্থায়ী সরকার এই সংগীতকে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু এখন সময় এসেছে নতুন একটি জাতীয় সংগীত নির্বাচন করার।" আযমী আরও বলেন, "বাংলাদেশের আরও অনেক সুন্দর গান আছে যা আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করা যেতে পারে।"