
তৌহিদুল ইসলামঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রথম ওশান স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন তথা ‘স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন ফর মেরিন রিমোট সেন্সিং এর (এসজিএসএমআরএস) নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন সেকেন্ড ইন্সিটিউট অফ ওশানগ্রাফির (এসআই ও) যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়ন হচ্ছে এ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়নে খরচ হবে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৬০ কোটি টাকার কারিগরি ও যান্ত্রিক সহায়তা দিচ্ছে চীনা প্রতিষ্ঠান। গত ২৬ মার্চ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। প্রকল্পটি চলতি বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে। এর মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদ আহরণ, ব্লু ইকোনমি ও আবহাওয়ার পূর্বাভাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস এবং সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এখনও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্যাটেলাইট তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের NOAA I JTWC এবং ভারতের IMD থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে প্রায় ২০-৩০ ঘণ্টা সময় লাগে। এ প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং পরনির্ভরশীল। এসব তথ্য ব্যবহার করে উচ্চ রেজুলেশনের মানচিত্র বা গাণিতিক মডেল তৈরি করা সম্ভব হয় না।
পাশাপাশি, সামুদ্রিক সম্পদ অন্বেষণ, আহরণ ও ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় ও নিরবচ্ছিন্ন তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা দেশের অভাবে আটকে আছে। এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে ভূমিকা রাখবে ওশান স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন। এ স্টেশন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পৃথিবী পর্যবেক্ষণকারী স্যাটেলাইট থেকে রিয়েল-টাইম তথ্য সংগ্রহ করবে। এর মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তারিত তথ্য মাত্র ১০-১৫ মিনিটে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হবে।
প্রকল্পটি ব্লু ইকোনমিতেও ভূমিকা রাখবে। জানা যায়, স্বাধীনতার আগে চিহ্নিত ফিশিং জোনগুলোতে মৎস্য সম্পদের বর্তমান অবস্থা নিশ্চিত নয়। ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হলেও তথ্যের অভাবে বঙ্গোপসাগরের মৎস্য ও সম্পদ আহরণের সম্ভাবনা অপূর্ণ রয়ে গেছে।
স্টেশনটি চালু হলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, স্রোতের গতি এবং ক্লোরোফিল ঘনত্বের তথ্য নিয়মিত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা যাবে। এতে সাইক্লোন ট্র্যাকিং, উপকূলীয় বন্যা মডেলিং, জলবায়ু পর্যবেক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনা সম্ভব হবে। পাশাপাশি, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানেও এটি সহায়তা করবে। এটি দেশের সামুদ্রিক গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এছাড়াও প্রকল্পটি ডাটা প্রসেসিং সেন্টার, ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জ, সাগরের গতিবিদ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সাইক্লোন ও সুনামি পূর্বাভাস, স্টর্ম সার্জ মডেলিং, শিক্ষা ও গবেষণা, শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, নীতিনির্ধারণে সহায়তা, সাগর নীতিমালা, বাংলাদেশের জন্য সুফল, প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা, গবেষণার নতুন দিগন্ত ও আঞ্চলিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।
প্রকল্পের সমন্বয়ক চবি ওশানোগ্রাফি বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন মুন্না বলেন, প্রকল্পটি একটি অত্যাধুনিক সুবিধা তৈরি করবে যা সমুদ্র গবেষণা, জলবায়ু পর্যবেক্ষণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব ঘটাবে। চীনের সেকেন্ড ওশানোগ্রাফি ইনস্টিটিউট (এসআইও) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের যৌথ আয়োজনে নির্মিত এ প্রকল্পটি বাংলাদেশকে সমুদ্র-প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলবে। পাকিস্তান ও ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের নিজস্ব ওশান স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন রয়েছে। তারা সমুদ্র সম্পদ ব্যবস্থাপনায় কাজে লাগাতে পারছে। কিন্তু আমরা পিছিয়ে আছি। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অংশে আধুনিক প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিংয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ নিশ্চিত করা গেলে সমুদ্র অর্থনীতি উন্নয়নে বাংলাদেশে অনেক দূর এগিয়ে যাবে খুব অল্প সময়ে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আমাদের গ্রাজুয়েট ও শিক্ষকরা নতুন উদ্যামে কাজ করতে সক্ষম হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ওশান স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের ফলে মেরিন সায়েন্সেস এন্ড ফিশারিজ অনুষদভুক্ত সকল বিভাগের শিক্ষক-গবেষক ও শিক্ষার্থীরা গভীর সমুদ্রে মহামূল্যবান সম্পদ নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ অবারিত হবে। একইসঙ্গে মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের ফলে গভীর সমুদ্রে কোন কোন জায়গায় কী ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তা নির্ণয় করা সহজতর হবে।